ইজতেমার দ্বিতীয় দিনে চলছে বয়ান তালিমঃ বিকেলে যৌতুকবিহীন বিয়ে

গাজীপুর, টঙ্গী | ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

৫৮তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের দ্বিতীয় ধাপ আজ তার দ্বিতীয় দিনে প্রবেশ করেছে। ইজতেমার ময়দানে দেশ-বিদেশের লাখো মুসল্লির উপস্থিতিতে চলছে বয়ান, তালিম ও দাওয়াতি কার্যক্রম। আজকের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ যৌতুকবিহীন বিয়ে, যা বিকেলে অনুষ্ঠিত হবে।

বিশ্ব ইজতেমার গুরুত্ব ও এর প্রভাবঃ

বিশ্ব ইজতেমা শুধু একটি ধর্মীয় সমাবেশ নয়, এটি বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম ইসলামিক জমায়েত। প্রতি বছর বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত এই ইজতেমায় লাখো ধর্মপ্রাণ মুসলিম অংশগ্রহণ করেন। ইজতেমার মূল উদ্দেশ্য হলো ইসলামের দাওয়াত, আত্মশুদ্ধি, এবং মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা।

প্রতি বছর ইজতেমা দুই পর্বে বিভক্ত হয়ে অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম পর্বে বাংলাদেশের ৩৩টি জেলার মুসল্লিরা অংশগ্রহণ করেন এবং দ্বিতীয় পর্বে বাকি ৩২ জেলার মুসল্লিরা অংশগ্রহণ করেন। তবে বিদেশি মেহমানরা দুই পর্বেই অংশগ্রহণ করতে পারেন।

ইজতেমার দ্বিতীয় দিনের কার্যক্রমঃ

ফজরের পর আম বয়ান ও তালিমঃ

আজকের কার্যক্রম শুরু হয় বাদ ফজর আম বয়ানের মাধ্যমে। পাকিস্তানের মাওলানা উবায়দুল্লাহ খুরশিদ উর্দুতে বয়ান করেন এবং তা বাংলায় তরজমা করেন বাংলাদেশের মাওলানা জাকারিয়া।

সকাল ৯:৪৫ মিনিটে ভারতের মাওলানা জামাল তালিমের মোজাকারা করেন। এরপর খিত্তায় খিত্তায় তালিম হয়, যেখানে মুসল্লিরা ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেন।

ইজতেমার দ্বিতীয় দিনে চলছে বয়ান তালিমঃ বিকেলে যৌতুকবিহীন বিয়ে
ইজতেমার দ্বিতীয় দিনে চলছে বয়ান তালিমঃ বিকেলে যৌতুকবিহীন বিয়ে

ওলামায়ে কেরামের আলোচনাঃ

সকাল ১০টায় বয়ান মিম্বারের সামনে ওলামায়ে কেরামদের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেন ভারতের মাওলানা ইব্রাহীম দেওলা। তিনি ইসলামের দাওয়াতি কার্যক্রমের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেন।

একই সময়ে মাদ্রাসার ছাত্রদের উদ্দেশ্যে কথা বলেন পাকিস্তানের মাওলানা ফরীদ। ইসলামী শিক্ষার গুরুত্ব এবং তাবলিগের কার্যক্রমে ছাত্রদের ভূমিকা নিয়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দেন।

যৌতুকবিহীন বিয়ে: ইসলামিক সমাজব্যবস্থার একটি অনন্য দৃষ্টান্ত

আজকের দিনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আয়োজন হলো বিকেলে অনুষ্ঠিতব্য যৌতুকবিহীন বিয়ে। এই বিয়েতে ইসলামী বিধান অনুসরণ করে কোনো যৌতুক ছাড়াই বর-কনে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হবেন।

যৌতুকবিহীন বিয়ের পটভূমিঃ

তাবলিগ জামাতের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো মুসলিম সমাজে ইসলামের সঠিক বিধান প্রচার করা। বর্তমান সমাজে বিয়ের সময় যৌতুক একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা অনেক পরিবারকে দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যৌতুকপ্রথা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, এবং এই কারণে ইজতেমার ময়দানে প্রতিবারই যৌতুকবিহীন বিয়ের আয়োজন করা হয়।

কিভাবে এই বিয়ে সম্পন্ন হয়?

বিয়ের জন্য আগ্রহী বর ও কনের অভিভাবকরা ইজতেমা ময়দানে আগে থেকে নিবন্ধন করেন। নির্ধারিত সময়ে কনের অভিভাবক বরকে কবুল বলে সম্মতি জানান এবং ইসলামি রীতি অনুযায়ী কাজী সাহেব বিয়ে সম্পন্ন করেন।

এই বছরও শতাধিক নবদম্পতি এই পবিত্র অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নতুন জীবন শুরু করবেন।
বাদ যোহর ও বাদ আসর বয়ান

বাদ যোহর ভারতের মাওলানা ইসমাঈল গোদরা ইসলামের দাওয়াতি কাজের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি বলেন, "তাবলিগ জামাতের মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকানো। এটি শুধু নামাজ-রোজার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং সম্পূর্ণ জীবনকে ইসলামের আলোকে পরিচালিত করাই আমাদের লক্ষ্য।"

বাদ আসর ভারতের মাওলানা জুহাইরুল হাসান বয়ান করেন। তিনি বয়ান শেষে যৌতুকবিহীন বিয়ে সম্পন্ন করাবেন।

বাদ মাগরিব ও রাত্রিকালীন বয়ানঃ

বাদ মাগরিব ভারতের মাওলানা ইব্রাহীম দেওলা বয়ান করবেন। রাতে মুসল্লিরা নিজেদের খিত্তায় তালিম ও জিকিরের মাধ্যমে ইবাদতে সময় কাটাবেন।

ইজতেমার দ্বিতীয় দিনকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তা ব্যবস্থাঃ

বিশ্ব ইজতেমার মতো বৃহৎ আয়োজন নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করতে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মো. নাজমুল করিম খান জানিয়েছেন, "ইজতেমার নিরাপত্তার জন্য পর্যাপ্ত পুলিশ ও র‍্যাব সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। পাশাপাশি সাদা পোশাকে গোয়েন্দা নজরদারিও চালানো হচ্ছে।"

ইজতেমার জন্য বিশেষ ট্রেনঃ

এছাড়া মুসল্লিদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য ১১টি বিশেষ ট্রেন চালু করা হয়েছে, যার মধ্যে বনলতা, কক্সবাজার এক্সপ্রেস, সুবর্ণলতা, পর্যটক এক্সপ্রেস ও সোনার বাংলা ট্রেন রয়েছে।

ইজতেমায় শ্বাসকষ্টে এক মুসল্লির মৃত্যুঃ

ইজতেমার দ্বিতীয় দিনে এক মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। গোপালগঞ্জ জেলার মকসেদপুর থানার গয়লাকান্দি গ্রামের বাসিন্দা আমির আলী শেখ (৬৫) সোমবার রাত ১১টার দিকে শ্বাসকষ্টজনিত কারণে টঙ্গী সরকারি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। বাদ ফজর ইজতেমা ময়দানে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়, এরপর মরদেহ গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের মধ্যে তার মৃত্যু শোকের ছায়া ফেলেছে।

আগামীকাল আখেরি মোনাজাতঃ

বিশ্ব ইজতেমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো আখেরি মোনাজাত। আগামীকাল (৫ ফেব্রুয়ারি) সকাল ১১টার পর মাওলানা মোহাম্মদ জুবায়ের সাহেবের পরিচালনায় আখেরি মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে।

ইজতেমার শেষ দিনে আল্লাহর রহমত ও দয়া চেয়ে লাখো মুসল্লি কান্নায় ভেঙে পড়েন। দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ কামনায় প্রার্থনা করেন।

বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় দিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ দ্বিতীয় দিনেই ইসলামের বিভিন্ন দিক নিয়ে গভীর আলোচনা হয়, তালিম চলে এবং সবচেয়ে বড় দিক হলো যৌতুকবিহীন বিয়ে। তাবলিগ জামাতের এই উদ্যোগ মুসলিম সমাজে বিয়ে সহজ ও ইসলামী পদ্ধতিতে সম্পন্ন করার জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করছে।

আগামীকাল আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে এই ধাপের ইজতেমার সমাপ্তি ঘটবে, এবং মুসল্লিরা দাওয়াতি কাজে বের হবেন, ইসলামের দাওয়াত ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url