গাস্ত কত প্রকারঃ বিস্তারিত খোলাসা আলোচনা
তাবলীগ জামাতে দাওয়াত ও তাবলীগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো গাস্ত। গাস্তে যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য হলো নিজের সংশোধন এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা, পাশাপাশি মানুষের মাঝে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছানো। আমরা এখানে গাস্ত কত প্রকার সেই সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
গাস্ত শব্দের অর্থ কি?
প্রথমে আমাদের জানতে হবে গাস্ত শব্দের অর্থ কি? গাস্ত একটি ফার্সি ভাষার শব্দ। গাস্ত এর অর্থ হলো ঘোরা-ফেরা করা। অর্থাৎ অন্তরে দরদ নিয়ে উম্মতের দ্বারে দ্বারে বারে বারে যাওয়ার নামই হলো গাস্ত।গাস্তে গিয়ে দাওয়াত দেওয়ার পদ্ধতিঃ
প্রথম কথা হলো গাস্ত একটি বহুত বড় মাপের উঁচু আমল । আর আমল মানুষ তিন কারণে করে:১। নামের জন্য
২। দামের জন্য
৩। রেজায়ী এলাহীর জন্য ।
এজন্য গাস্তে যাওয়ার আগে নিজের নিয়তকে সহীহ করে নিবো। বড়রা বলেন এই কাম যে নিজের জন্য করবে না সে কেটে যাবে। তাই গাস্তে যাওয়ার একমাত্র উদ্দেশ্য হবে আমার নিজের সংশোধন এবং আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি। যে ভাইয়ের কাছে আমি যাচ্ছি তার হেদায়েতের দায়িত্ব আমার না। বরং হেদায়েতের মালিক আল্লাহতায়ালা। আল্লাহ যাকে খুশি হেদায়েত দেবেন আর যাকে খুশি গোমরাহ করবেন। আমার দাওয়াতে কেউ দ্বীনের পথে ফিরলে আমি খুশিও হবোনা আবার দ্বীনের পথে না আসলে আমি গোস্বাও হবো না। বরং ভয়ের সাথে এই কাজকে করতে থাকবো যেন আল্লাহপাক গোস্বা হয়ে কখনো আমাকে এই কাজ থেকে সরিয়ে না দেন। হযরতজী রহঃ বলেন, ডরতে রাহো, মাংতে রাহো, রোতে রাহো, মানতে রাহো। অর্থাৎ কাম করতে থাকো ভয়ের সাথে, চাইতে থাকো কেদে কেদে, আর মানতে থাকে মানার মতো। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো দাওয়াতের কাম করনেওয়ালার জন্য দুই জিনিস সবচেয়ে জরুরি। এক হলো মেহনত আর দ্বিতীয় হলো সোহবত। তাই আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মেহনত করতে থাকবো আর বড়দের সোহবতে থেকে এই কাজকে শিখতে থাকবো।
গাস্তের প্রকারঃ
আল্লাহর রাস্তায় বের হয়ে প্রত্যেকটা সাথীকেই নানাভাবে গাস্ত করতে হয় । এসমস্ত গাস্তকে আবার কয়েকভাবে ভাগ করা হয়েছে। গাস্তের প্রকার অনুসারে ৫ ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
১। খুসুসি গাস্ত
২। তালিমী গাস্ত
৩। উমুমি গাস্ত
৪। তাশকিলি গাস্ত
৫। উসুলি গাস্ত
![]() |
গাস্ত কত প্রকার? |
পাচ প্রকার গাস্তের বিস্তারিত খোলাসাঃ
১। খুসুসি গাস্তঃ
জামাতে গিয়ে মঞ্জিল করার পর মসজিদে ঢুকে আমরা যে গাস্তে যাই সেটাই হলো খুসুসি গাস্ত । অর্থাৎ এই গাস্তে খাসভাবে কিছু লোকের সাথে সাক্ষাৎ করতে হয়। এখানে মূলত তিন শ্রেণির লোকের সাথে সাক্ষাৎ করা হয়। অনেকে এই তিন শ্রেণির লোককে এভাবে বলে দ্বীনের বড়, দুনিয়ার বড়, কাজের বড়। তবে আমাদের মুরুব্বিরা এখন এভাবে বলতে নিষেধ করেন। কারন দ্বীন, দুনিয়া, কাজ এই তিনটার বড়ই আল্লাহতায়ালা। বরং আমরা দ্বীনের বড় না বলে বলবো ওলামায়ে কেরাম, দুনিয়ার বড় না বলে বলবো খাস লোক, আর কাজের বড় না বলে বলবো পুরানা সাথী। এই তিন শ্রেণির লোকের কাছে আমরা এভাবে দাওয়াত পেশ করতে পারি।
ক) ওলামা হযরতঃ
ওলামায়ে কেরাম যেহেতু দ্বীনের ব্যাপারে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি জানেন এবং তারা দ্বীনী অনেক তাকাজায় ব্যাস্তও থাকেন । তাই আমরা তাদের কাছে সাক্ষাতের সময় ভুলেও কোন দাওয়াত দিতে যাবোনা। বরং তাদের মহামূল্যবান সময় থেকে আমরা আমাদের জামাতের জন্য কিছু সময় চেয়ে নিয়ে আসবো। আমরা তাদের জন্য কিছু হাদিয়া পারলে নিয়ে যাবো।
খ) খাওয়াস লোকঃ
সমাজের মধ্যে কিছু খাওয়াস লোক থাকে। যেমন: মেম্বার, চেয়ারম্যান গণ্যমান্য ব্যক্তি ইত্যাদি। এরা সমাজের প্রতিনিধি, তাদের কথা মানুষ শুনে। এদের কাছে গিয়ে এদের দুনিয়ার নিয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলবো এগুলো সবই আল্লাহর । আল্লাহপাক সুলাইমান (আঃ) কে সারা দুনিয়ার নিয়ামত দান করেছিলেন তিনি শুকরিয়া আদায় করেছিলেন আল্লাহপাক তাকে দুনিয়া আখিরাত উভয় জাহানে সফলকাম করেছেন। অপর দিকে ফেরাউনকে নিয়ামত দিয়েছিলেন, সে নাফরমানির কারনে উভয় জাহানে জিল্লতির শিকার হয়েছে। এজন্য ভাই আপনারা ব্যাস্ত মানুষ, আপনাদের ব্যাস্ত সময় থেকে আল্লাহর জন্য কিছু সময় দিলে আল্লাহপাকও খুশি হতো আমরাও হতাম। আপনারা সমাজের প্রতিনিধি আপনাদের কথা শুনে সমাজের অনেক মানুষ হয়তোবা দ্বীনের পথে ফিরে আসবে।
গ) পুরাতন সাথীঃ
পুরাতন সাথী যারা আছে তাদের কাছে গিয়ে আমরা আমাদের জামাতের কার্গোজারি শুনাবো। পারলে তাদের সাথে করে নিয়ে এসে আমীর সাহেবের হাওয়ালা করে দিবো। আমীর সাহেব পুরাতন সাথীদে নিয়ে বসে কিভাবে মহল্লা থেকে নগদ জামাত বের করা যায় তাঁর একটা রোডম্যাপ তৈরি করে ফেলবেন।
২। তালিমি গাস্তঃ
ফজায়েলে আমল কিতাবের কুরআন অংশ থেকে পড়ে আমরা মশক সেরে নিব। এরপর অন্যান্য অংশ, থেকে যখন তালিম শুরু হবে তখন দুই সাথী করে আমরা গাস্তে যাবো। এলাকার মধ্যে কিছু লোক দেখা যায় রাস্তা ঘাটে, দোকানে বসে অলস সময় পার করছে। এদের কাছে আমরা তালিম শুনার ফাযায়েল বলে দাওয়াত দিবো। তারা যতটুকু সময় দেয়ার জন্য রাজি হয় ঠিক ততটুকু সময় পরে আমরা ছেড়ে দিবো। এমন যেন না হয় ৫ মিনিট সময়ের কথা বলে নিয়ে এসে ৩০ মিনিট বসিয়ে রাখলাম।
৩। উমুমি গাস্তঃ
জমাতে বা মহল্লায় আছরের পর যে গাস্ত করা হয় তাকে উমুমি গাস্ত বলে। আছরের পর এলান দিয়ে গাস্তের আদব বলে ৮/১০ জন সাথী মিলে মহল্লার মধ্যে গাস্তে বের হয়ে যায়।
৪। তাশকিলি গাস্ত:
চলতি জামাতে থাকা অবস্থায় অথবা মহল্লায় থাকা অবস্থায় ফজরের পর আমরা যে গাস্তে বের হই তাকে তাশকিলি গাস্ত বলে। তাশকিলি গাস্তে গিয়ে আমরা তিন জিনিসের দিকে দাওয়াত দিবো।
ক) দুনিয়া থেকে আখিরাতের।
খ) মাল থেকে আমালের দিকে।
গ) মাখলুক থেকে খালেকের দিকে ।
৫ প্রকার গাস্তের মধ্যে উছুলি গাস্ত হলো সবচেয়ে কঠিন। চলতি জামাতে অথবা মহল্লায় তাশকিলি গাস্ত করার পর আমরা সাথীদের কে উসুল করে আনার জন্য যে গাস্তে যাই সেটাই উসুলি গাস্ত। চলতি জামাতে সাধারণত তৃতীয় দিন মাগরিবের পর থেকে পরেরদিন সকালে মসজিদ বদলানোর আগে পর্যন্ত উসুলি গাস্ত চলতে থাকে। এক্ষেত্রে মহল্লার সাথীরা অনেক ওজর আপত্তি পেশ করতে থাকে। তাদেরকে আল্লাহর রাস্তায় বের হওয়ার ফাজায়েল বলে উদ্বুদ্ধ করে নগদ কিছু টাকা অথবা বেডিং উসুল হিসেবে নিয়ে আসা।
ক) দুনিয়া থেকে আখিরাতের।
খ) মাল থেকে আমালের দিকে।
গ) মাখলুক থেকে খালেকের দিকে ।
ক। দুনিয়া থেকে আখিরাতের দিকেঃ
দুনিয়া হলো ক্ষনস্থায়ী। আর আখিরাত হলো চিরস্থায়ী । ক্ষনস্থায়ী এই ধোকার ঘর দুনিয়া ছেড়ে চিরস্থায়ী আখিরাতে আমাদের পাড়ি জমাতে হবে। আখিরাতের কথা খুলে খুলে বলে সময় নিয়ে দাওয়াত দিতে হবে।খ। মাল থেকে আমালের দিকেঃ
দুনিয়ার মানুষ মালমুখি । মালমুখি মানুষকে আমালের দিকে দাওয়াত দিতে হবে। মালের কারণে কারুন কিভাবে ধ্বংস হয়েছিল। এছাড়া মালদাররা মাল জমা করার কারনে কিভাবে বরবাদ হয়েছে বিস্তারিত বলে দাওয়াত দিতে হবে।গ। মাখলুক থেকে খালেকের দিকেঃ
দুনিয়ার মানুষ মাখলুকমুখি । অথচ সাহাবীরা ছিলেন খালেক মুখি । জুতার একটা ফিতা ছিঁড়লেও সাহাবীরা আল্লাহপাকের কাছ থেকে চেয়ে নিতেন। তাই মাখলুকমুখি মানুষকে এমন ভাবে দাওয়াত দিতে হবে যেন দীল থেকে গায়রুল্লাহ বের হয়ে গিয়ে সেখানে আল্লাহ পাক বসে যান।
৫। উসুলি গাস্তঃ
উসুল শব্দের অর্থ কি? উসুল শব্দের অর্থ হলো মূল। উসুলি গাস্ত হলো মূল গাস্ত। অর্থাৎ এই গাস্তই হলো তাবলীগের ভিত্তি ।৫ প্রকার গাস্তের মধ্যে উছুলি গাস্ত হলো সবচেয়ে কঠিন। চলতি জামাতে অথবা মহল্লায় তাশকিলি গাস্ত করার পর আমরা সাথীদের কে উসুল করে আনার জন্য যে গাস্তে যাই সেটাই উসুলি গাস্ত। চলতি জামাতে সাধারণত তৃতীয় দিন মাগরিবের পর থেকে পরেরদিন সকালে মসজিদ বদলানোর আগে পর্যন্ত উসুলি গাস্ত চলতে থাকে। এক্ষেত্রে মহল্লার সাথীরা অনেক ওজর আপত্তি পেশ করতে থাকে। তাদেরকে আল্লাহর রাস্তায় বের হওয়ার ফাজায়েল বলে উদ্বুদ্ধ করে নগদ কিছু টাকা অথবা বেডিং উসুল হিসেবে নিয়ে আসা।
শেষ কথাঃ
প্রতিটি প্রকারের গাস্তের নিজস্ব আদব ও পদ্ধতি রয়েছে, যা অনুসরণ করলে দাওয়াতের কাজ আরও সুচারুভাবে করা যায়। গাস্তের মাধ্যমে নিজেকে সংশোধন এবং অন্যদের দ্বীনের পথে আহ্বান করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে এই দাওয়াতী কাজ করতে হলে নিয়তকে খালিস রাখা এবং বড়দের সোহবতে থেকে এই মেহনত চালিয়ে যেতে হবে মওত পর্যন্ত। আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে তৌফিক দান করেন (আমিন)।