ছয় সিফাত সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত মোজাকারা

আলহামদুলিল্লাহ, সর্ব প্রথম শোকরিয়া আদায় করি ঐ আল্লাহ তায়ালার যিনি আমাদেরকে অসংখ্য নেয়ামত দান করেছেন । সবচেয়ে বড় নেয়ামত হলো বিনা চাওয়াতে ঈমান দান করেছেন । ঈমান এত বড় নেয়ামত কেউ যদি যার্‌রা পরিমান ঈমান নিয়ে দুনিয়া থেকে যেতে পারে আল্লাহ তায়ালা তাকে এই দুনিয়ার দশ গুন বড় জান্নাত দিবেন । আর শুধু ‘আল্লাহ’ বলতে পারে এমন একজন ঈমান ওয়ালা থাকা অবস্থায় আল্লাহ তায়ালা সাত আসমান জমিনকে ধ্বংস করবেন না । আমাদের এই মজমার চতুর্দিকে ফেরেশতারা বেষ্টন করে আছেন । শেষ পর্যন্ত যারা বসা থাকবে আল্লাহ তায়ালা তাদের গুনাহকে মাফ করে দিবেন এবং গুনাহের যায়গা গুলো নেকি দ্বারা ভরপুর করে দিবেন ।

আল্লাহ তায়ালা হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন । এই দ্বীন মোতাবেক চলার মধ্যেই দুনিয়া আখিরাতে সমস্ত মানব জাতির শান্তি ও সফলতা রয়েছে । কিন্তু আজ আমরা দ্বীন মানার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছি । তাই কয়েকটি গুনের উপর মেহনত করে আমল করতে পারলে দ্বীনের উপর চলা অতি সহজ । গুন কয়টি হলোঃ ১। কালেমা ২। নামাজ ৩। এলেম ও জিকির ৪। একরামে মুসলিম ৫। এখলাসে নিয়ত ৬। দাওয়াত ও তাবলীগ।

কালেমাঃ- লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ । এর অর্থ হলো- নাই কোন মাবুদ আল্লাহ তায়ালা ছাড়া এবং হযরত মুহাম্মদ ( সঃ ) আল্লাহ তায়ালার রাসূল । কালেমার হাকিকত হলো আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আমরা যা কিছু দেখি বা না দেখি সবই মাখলুক । মাখলুক কিছুই করতে পারেনা আল্লাহ তায়ালার হুকুম ছাড়া । আল্লাহ তায়ালা সবকিছু করতে পারেন মাখলুক ছাড়া ।

ইব্রাহীম (আঃ) কে নমরুদ যখন আগুনে নিক্ষেপ করে তার পূর্ব মূহুর্তে জিব্রাঈল (আঃ) এসে ইব্রাহীম (আঃ) কে সাহায্যের আবেদন জানান । ইব্রাহীম (আঃ) মাখলুকের সাহায্য না নিয়ে বলেন, আল্লাহ তায়ালাই আমার জন্য যথেষ্ট । আল্লাহ তায়ালার উপর পূর্ণ বিশ্বাস রাখায় আল্লাহ তায়ালা খুশি হয়ে আগুন কে হুকুম করেন, হে আগুন! তুমি ইব্রাহীমের জন্য শান্তিদায়ক ঠান্ডা হয়ে যাও । উলামায়ে কেরাম বলেন ইব্রাহীম (আঃ) ৪০ দিন পর্যন্ত আগুনের মধ্যে বসে বসে আঙ্গুর খাচ্ছিলেন । এই ঘটনা থেকে বুঝা যায় মাখলুক কিছুই করতে পারে না আল্লাহ তায়ালার হুকুম ছাড়া ।

রাত দিনের পরিবর্তন, ক্ষমতার পালাবদল, জীবন-মরণ, ইজ্জত-বেইজ্জত, হেফাজত-ধ্বংস, সুস্থতা-অসুস্থতা সবই আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল । জমিন ফসল দেয় না, ফসল আল্লাহ তায়ালাই দেন । মেঘ বৃষ্টি দেয় না, বৃষ্টি আল্লাহ তায়ালাই দেন । মহিলা বাচ্চা প্রসব করে না, আল্লাহ তায়ালার হুকুমে মহিলা বাচ্চা প্রসব করে । মহিলার যদি বাচ্চা প্রসব করার ক্ষমতা থাকতো তাহলে সব মহিলাই বাচ্চা প্রসব করতো । আল্লাহ তায়ালা যদি চান বাপ ছাড়াই সন্তান দিতে পারেন । যেমন ঈসা (আঃ) কে বাপ ছাড়াই পয়দা করেছেন । দৈনন্দিন জীবনেও দেখা যায় একই পাতিলের ভাত খেয়ে দাদা দিন দিন দূর্বল হচ্ছে আর নাতি দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে । আসলে ভাতের কোন ক্ষমতা নাই ।

প্রকৃতপক্ষে দুনিয়ার কোন কিছু হওয়া বা না হওয়া সবই আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল । এ ব্যাপারে মাখলুকের নিজস্ব কোন ক্ষমতা নাই । একারনেই ইঊসুফ (আঃ) কুয়ার মধ্যে, ইউনুস (আঃ) মাছের পেটে, হাযেরা (রাঃ) এবং ঈসমাইল (আঃ) অনাবাদী ময়দানে, ঈসা (আঃ) দুশমনের মোকাবেলায় ,শিশু মুসা (আঃ)বাক্সের মধ্যে, ঈসমাইল (আঃ) ছুরির নীচে এবং হুজুর (সঃ) হিজরতের সময় সওর গুহায় নিরাপদ ছিলেন।

মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সঃ):- কালেমার আরেক অংশ মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সঃ) । অর্থাৎ মুহাম্মদ (সঃ) কে আল্লাহ তায়ালার রাসূল হিসেবে স্বীকার করা এবং নবিজীর তরীকায় চলার মধ্যেই সমস্ত মানব জাতির দুনিয়া ও আখেরাতের শান্তি ও কামিয়াবী রয়েছে , এটা মেনে নেওয়া । আর নবিজীকে নিজের জীবনের চাইতে বেশী মহাব্বত করা । এক হাদিসে আছে যার সারাংশ হলো, যে আমার সুন্নতকে মহব্বত করল, সে যেন আমাকেই মহব্বত করল, আর যে আমাকে মহব্বত করে জান্নাতে সে আমার সাথে থাকবে । রমজান মাস আসার পর যেমন নফল রোজার সুযোগ থাকে না । ঠিক তেমনি হুজুর (সঃ) এর জামানায় অন্য কোন নবীর তরীকা চলবে না ।

উলামায়ে কেরাম বলেন, একটা সুন্নতের দাম আসমান জমিনের চাইতেও বেশী । আরেক হাদীসে আছে, ফেৎনার জামানায় যে একটা সুন্নতকে আকড়ে ধরবে সে শত শহীদের সওয়াব পাবে । সুন্নত তরীকা ছাড়া কোন আমলকে কবুল করা হবে না । সুন্নত তরীকায় যে কোন আমল করতে যদি কেউ মারা যায় সে জান্নাতী হবে । সাহাবায়ে কেরাম হুজুর (সঃ) কে অন্ধভাবে অনুসরণ করতেন । হাজরে আসওয়াদকে ( কালো পাথর ) চুম্বন করার সময় উমর (রাঃ) বলেন- হে হাজরে আসওয়াদ! আমি জানি তুমি একখন্ড পাথর ছাড়া আর কিছুই না । তুমি মানুষের উপকারও করতে পার না, ক্ষতিও করতে পার না । আমি আল্লাহ তায়ালার নবীকে দেখেছি তোমাকে চুম্বন করতে তাই আমি উমর চুম্বন করলাম, তা নাহলে কোন দিন একাজ করতাম না ।

নামাজঃ- নামাজের উদ্দেশ্য হলো বান্দার যা কিছু প্রয়োজন, তা নামাজ পড়ে আল্লাহ তায়ালার সীমাহীন ভান্ডার থেকে নেয়ার অভ্যাস পয়দা করা। এজন্য হুজুর (সঃ) যে ভাবে নামাজ পড়েছেন এবং সাহাবায়ে কেরাম (রাযিঃ) গণকে যেভাবে নামাজ শিক্ষা দিয়েছেন সেভাবে নামাজ পড়ার যোগ্যতা অর্জন করা ।

এক হাদীসে আছে, যে ব্যাক্তি সময়মত গুরুত্ব সহকারে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করবে, আল্লাহ তায়ালা তাকে নিজ দায়িত্বে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন । আরেক হাদীসে আছে, যে ব্যাক্তি নামাজের এহতেমাম করে আল্লাহ তায়ালা তাকে পাঁচ প্রকারে সম্মানিত করেন । প্রথমতঃ তার উপর থেকে রুজি রুজগারের অভাব দূর করে দেওয়া হয়। দ্বিতীয়তঃ তার উপর থেকে কবরের আজাব হটিয়ে দেওয়া হয় । তৃতীয়তঃ কিয়ামতের দিন তার আমলনামা ডান হাতে দেওয়া হবে। চতুর্থতঃ সে ব্যক্তি পুলসিরাতের উপর দিয়ে বিদ্যুতের মত পার হয়ে যাবে । বিনা হিসাবে বেহেশতে প্রবেশ করবে ।

আল্লাহ তায়ালা সর্বপ্রথম নামাজ ফরজ করেছেন এবং কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম নামাজেরই হিসাব নেওয়া হবে । যার নামাজ ঠিক হবে সে কামিয়াব হবে । আর যদি নামাজ ঠিক না হয় তাহলে সে ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্থ হবে । ফরজ নামাজে ঘাটতি থাকলে নফল দ্বারা পুরা করা হবে । এজন্য প্রত্যেকেরই ফরজ নামাজের পাশাপাশি নফলের পুঁজি থাকা দরকার ।

যখন কোন ব্যক্তি নামাজে দাঁড়ায়, তখন আল্লাহ তায়ালা তার দিকে পুরোপুরি মনযোগ দেন । যখন সে নামাজ হতে মনযোগ সরিয়ে নেয়, তখন আল্লাহ তায়ালাও মনযোগ সরিয়ে নেন । সেজদার অবস্থায় মানুষ আল্লাহ তায়ালার সবচেয়ে বেশী নিকটবর্তী হয় । আল্লাহ তায়ালা সেজদার জায়গাগুলিকে জাহান্নামের উপর হারাম করে দিয়েছেন । জমিনের যে অংশের উপর নামাজ পড়ে আল্লাহ তায়ালাকে স্মরন করা হয়, সে অংশটি জমিনের অন্যান্য অংশের উপর গর্ব করে । যে ব্যক্তি নামাজ পড়ে না ইসলামে তার কোন অংশ নাই । মানুষের শরীরের জন্য মাথা যেমন জরুরি, দ্বীনের জন্য নামাজ ঐরকম জরুরি । সর্বোপরি নামাজ হলো বেহেশতের চাবি।

শীতকালে যেমন গাছের পাতা ঝড়ে যায় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়লে তার গুনাহ সমূহ ঝড়ে যায় । আবার কেউ যদি দিনে পাঁচ বার গোসল করে তার শরীরে যেমন ময়লা থাকেনা, দিনে পাঁচ বার নামাজ পড়লেও তার শরীরে কোন গুনাহ থাকে না।

এক সাহাবী বলেন, যখন হুজুর (সঃ) এর ঘরে কোন অভাব দেখা দিত, তখন তিনি পরিবার পরিজনকে নামাজের হুকুম দিতেন । তাই সাহাবায়ে কেরাম (রাযিঃ) গনও যে কোন সমস্যায় পড়লে নামাজকেই প্রাধ্যন্য দিতেন । ঘরে খাবার নেই নামাজ পড়ে আল্লাহ তায়ালার কাছ থেকে খাবারের ব্যবস্থা করেছেন । গাধা মারা গিয়েছে, নামাজের মাধ্যমেই আল্লাহ তায়ালার কাছে সাহায্য চেয়েছেন । এক মহিলার বাচ্চা মারা গেলে নামাজ পড়ে আল্লাহ তায়ালার নিকট দোয়া করেছেন, আল্লাহ তায়ালা তার বাচ্চাকে জীবিত করে দিয়েছেন । বিপদগ্রস্থ একজন কুলি যখন নামাজ পড়ে আল্লাহ তায়ালাকে স্মরণ করেছেন আল্লাহ তায়ালা সাথে সাথে তাকে বিপদমুক্ত করে দিয়েছেন ।

প্রকৃতপক্ষে নামাজ যখন নামাজের মত হবে তখন দুনিয়া আখেরাতের সমস্ত সমস্যার সমাধান নামাজের মাধ্যমেই হবে। একবার হযরত আলী (রাযিঃ) এর উরুতে তীর বিদ্ধ হয়েছিল । লোকেরা অনেক চেষ্টা করেও যখন বের করতে পারল না, তখন পরামর্শ করা হলো যে নামাজের অবস্থায় তা বের করা যাবে । আলী (রাযিঃ) যখন নফল নামাজে দাঁড়ালেন এবং সেজদায় গেলেন তখন লোকেরা তীর টেনে বের করল । নামাজ শেষ করে আলী (রাযিঃ) লোকজন দেখে বললেন তোমরা আমার তীর বের করতে এসেছ? লোকেরা বলল আমরাতো বের করে ফেলেছি । তিনি বললেন আমি টেরই পাইনি । আয় আল্লাহ ! আমাদেরকে ঐ রকম নামাজ পড়ার তৌফিক দান করুন ।

আমাদের করণীয় হলো, আযান হওয়ার সাথে সাথে পুরুষরা মসজিদে যাবে আর মহিলারা ঘরে আওয়াল ওয়াক্তে নামাজ পড়ে নিবে । কারণ আল্লাহ তায়ালার নিকট সবচেয়ে পছন্দনীয় আমল হলো আওয়াল ওয়াক্তে নামাজ পড়া ।

এলেমঃ- এলেমের উদ্দেশ্য হলো আল্লাহ তায়ালার কখন কি হুকুম তা সঠিক ভাবে জেনে হুজুর (সঃ) এর তরীকা অনুযায়ী আমল করা । অর্থাৎ কোন্‌টা পাক, কোন্‌টা নাপাক, কোন্‌টা জায়েজ, কোন্‌টা নাজায়েজ, কোন্‌টা আগে করতে হবে, কোন্‌টা পরে করতে হবে এতটুকু এলেম শিক্ষা করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য ফরজ । এলেম প্রধানত ২ প্রকার । (১) ফাযায়েলে এলেম (২) মাসায়েলে এলেম । ফাযায়েলে এলেম গুলো তালিমের হালকায় বসে শিখবো । আর মাসায়েলে এলেম গুলো হক্কানী আলেমদের কাছ থেকে শিখবো । মহিলারা মাহরাম পুরুষের মাধ্যমে আলেমদের কাছ থেকে জেনে নিবে। যে ব্যাক্তি এলেম শিক্ষার জন্য কোন রাস্তা অবলম্বন করে, আল্লাহ তায়ালা তার জন্য জান্নাতের রাস্তা সহজ করে দেন । আর ফেরেশতারা তালেবে এলেমের জন্য আপন ডানা বিছিয়ে দেন । এমনকি গর্তের পিঁপড়া থেকে সমুদ্রের মাছ পর্যন্ত তার জন্য এস্তেগফার করে ।

হুজুর (সঃ) বলেন, যার সারাংশ হলো, তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি উত্তম যে নিজে কোরআন শিক্ষা করে এবং অপরকে শিক্ষা দেয় । এলেমের একটি অধ্যায় শিক্ষা করা এক হাজার রাকাত নফল নামাজ পড়ার চেয়েও উত্তম । এলেম শিক্ষা করা অবস্থায় যদি কেউ মারা যায় সে শহিদের মর্যাদা পায় ।

আমরা নিজেরাও এলেম শিখবো এবং আমাদের বাচ্চাদেরকেও এলেম শিখাব । এক হাদীসে আছে, যে ব্যক্তি নিজের সন্তানকে কুরআন শরীফ নাজেরা পড়ায়, তার আগের ও পরের সকল গুনাহ মাফ হয়ে যায় । আরেক হাদীসে আছে, শিশুরা যখন কথা বলতে শিখে প্রথমে তাদেরকে লা-ইল্লাহা ইল্লাল্লাহ শিখাও ।

আরেক হাদীসে আছে , যার সারাংশ হলো, প্রত্যেক মানব সন্তানই ফিতরতের উপর অর্থাৎ ইসলামের উপর জম্মগ্রহন করে থাকে । অতঃপর বাবা-মা তাকে ইয়াহুদী বানায় অথবা নাসারা অর্থাৎ খৃষ্টান বানায় অথবা অগ্নি উপাসক বানায় ।

জিকিরঃ- জিকিরের উদ্দেশ্য হলো, সদা সর্বদায় আল্লাহ তায়ালার ধ্যান খেয়াল অন্তরে পয়দা করা । অর্থাৎ আমি যেখানেই থাকিনা কেন আল্লাহ তায়ালা আমাকে দেখেন, আমার কথা শুনেন এবং আমার অন্তরের খবরও জানেন , এই অনুভূতি দিলের মধ্যে পয়দা করা । ফলে কোন বান্দার পক্ষে আল্লাহ তায়ালার নাফরমানি করা সম্ভব না । কোন চোর চুরি করার সময় যদি মালিক দেখে ফেলে তাহলে যেমন চুরি করা সম্ভব না, ঠিক তেমনি গুনাহ করার সময় যদি মনে হয় আল্লাহ তায়ালা আমাকে দেখতেছেন তাহলে আর গুনাহ করা সম্ভব না । যাদের জিহ্বা আল্লাহ তায়ালার জিকিরের দ্বারা তাজা থাকবে তারা হাসতে হাসতে জান্নাতে প্রবেশ করবে । যে জিকির করে সে জিন্দা সমতুল্য, আর যে জিকির করে না সে মুর্দা সমতুল্য । জান্নাতে যাওয়ার পর জান্নাত বাসীদের দুনিয়ার কোন জিনিসের জন্য আফছোছ হবে না, শুধু মাত্র ঐ সময় টুকুর জন্য আফছোছ হবে, যা দুনিয়াতে আল্লাহ তায়ালার জিকির ছাড়া কেটেছে । প্রতিদিন সকাল বিকাল অজিফা আদায় করা । সোবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, ওয়া লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার একশত বার, যেকোন দরূদ শরীফ একশত বার, যেকোন এস্তেগফার একশত বার, যাকে তিন তাসবীহ বলা হয় । এস্তেগফার বেশী বেশী পড়া । নবিজী দৈনিক একশত বার এস্তেগফার পড়তেন অথচ তার আগে পিছের সকল গুনাহ মাফ ছিল । এস্তেগফারের তিনটা বড় বড় ফায়দা হলোঃ (১) এমন যায়গা থেকে রিযিকের ব্যবস্থা হবে যা বান্দার ধারণাও ছিল না । (২) দুশ্চিন্তা দূর হয়ে যাবে । (৩) সংকীর্ণতায় আল্লাহ তায়ালা রাস্তা বের করে দিবেন । প্রতিদিন কোরআন তেলাওয়াত করবে । ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) এর মতে কোরআনের হক হলো বছরে দুই খতম । দরূদ শরীফ বেশী বেশী পড়া । ১ বার দরূদ পড়লে ৪০টি ফায়দা । ১০টি নেকি হবে, ১০টি গুনাহ মাফ হবে, ১০ টি রহমত নাযিল হবে এবং জান্নাতে ১০ গুন মর্যাদা বৃদ্ধি হবে । আর মাসনুন দোয়াগুলো শিখা এবং আমলের অভ্যাস পয়দা করা ।

একবার নবিজী (সঃ) সাহাবাদেরকে বলেন, যার সারাংশ হলো, তোমাদের মধ্যে কি কেউ এমন নাই, যে প্রতিদিন ওহুদ পাহাড় পরিমান আমল করবে? সাহাবায়ে কেরাম বলেন, কে এমন আছে যে ইহার ক্ষমতা রাখে? হুজুর (সঃ) বলেন, সোবহানাল্লাহ এর সওয়াব ওহুদ হইতে বেশী, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ ওহুদ হইতে বেশী, আল্লাহু আকবার ওহুদ হইতে বেশী । আরেক হাদীসে এসব প্রতিটি কালেমার পরিবর্তে জান্নাতে একটি করে গাছ লেগে যাওয়ার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে । শত ব্যস্ততার মধ্যেও খুব সহজেই আমরা এসব নেকি অর্জন করতে পারি ।

একরামে মুসলিমঃ- একরামের উদ্দেশ্য হলো কালেমার খাতিরে প্রত্যেক মুসলমানকে নিজের চেয়ে বড় মনে করার অভ্যাস করা। এর দ্বারা প্রত্যেক মুসলমানের হক আদায় করা সহজ হবে। মুসলমানদের মধ্যে আপোষে জোড় মিল পয়দা হবে এবং কাফির মুশরিকরা ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হবে ।

এক হাদীসে আছে, সমস্ত মাখলুক আল্লাহ তায়ালার পরিবার । সুতরাং আল্লাহ তায়ালার নিকট সর্বাধিক প্রিয় ঐ ব্যক্তি, যে তার পরিবারের বেশী উপকার করে । যে ব্যক্তি আপন ভাইয়ের কোন হাজত পুরা করার জন্য রওয়ানা হয় এবং চেষ্টা করবে , তবে তা দশ বছর এতেকাফ করার চেয়েও উত্তম হবে ।

ইয়াহিয়া বারমাকী (রহঃ) সুফিয়ান সওরী (রহঃ) এর জন্য প্রতি মাসে এক হাজার দেরহাম খরচ করতেন সুফিয়ান সওরী (রঃ) এই বলে দুয়া করতেন , হে আল্লাহ ! ইয়াহিয়া আমার দুনিয়ার প্রয়োজন মিটিয়ে দিয়েছে তুমি তার আখেরাতের প্রয়োজন মিটিয়ে দাও। ইয়াহিয়া বারমাকী (রহঃ) এর ইন্তেকালের পর লোকেরা তাকে স্বপ্নে দেখে তার হালত জানতে চাইলে তিনি বলেন, সুফিয়ানের দোয়ার বদৌলতে আল্লাহ তায়ালা আমাকে মাফ করে দিয়েছেন ।

এক হাদীসে আছে, যার সারাংশ হলো, যে ব্যক্তি কোন মুসলমানকে কোন কথার দ্বারা সাহায্য করে, অথবা তার সাহায্যের জন্য রওয়ানা হয় আল্লাহ তায়ালা তার উপর তেহাত্তরটি রহমত নাযিল করেন । তার মধ্যে একটি দ্বারা তার দুনিয়া ও আখেরাতের ফয়সালা হবে । আর বাহাত্তরটি আখেরাতের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য জমা থাকবে ।

কিতাবে আছে, এক দুশ্চরিত্রা মেয়েলোক একটি কুকুরকে পানি পান করানোর জন্য আল্লাহ তায়ালা তাকে মাফ করে দিয়েছেন । এক জালেম বাদশা পাঁচরাওয়ালা একটি কুকুরকে খেদমত করার কারণে আল্লাহ তায়ালা তাকেও মাফ করে দিয়েছেন । অপরদিকে এক মহিলা একটি বিড়ালকে বেঁধে রেখেছিল । বিড়ালটি ক্ষুধার তাড়নায় মারা যায় । না সে খাবার দিয়েছে, না ছেড়ে দিয়েছে । এই অপরাধে ঐ মহিলাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে ।

একজন মুসলমানের দাম আসমান জমিনের চেয়ে বেশী কাজেই মুসলমান সম্পর্কে খারাপ ধারনা করবো না । দোষ তালাশ করবো না এবং গীবত করবো না । যার গীবত করা হয় তার আমলনামায় নেকি চলে যায় । বরং দোষ গোপন করবো । যে অন্যের দোষ গোপন রাখে, আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন তার দোষ গোপন রাখবেন । মুসলমানের সাথে ঝগড়া করবো না । ঝগড়া নেকি সমূহকে ঐ ভাবে শেষ করে দেয় যেমন ক্ষুর মাথার চুলকে শেষ করে দেয়। হিংসা করবো না। হিংসা নেকি সমূহকে এমন ভাবে শেষ করে দেয় যেমন আগুন শুকনা কাঠকে শেষ করে দেয়। অহংকার করবো না। অহংকার হলো আল্লাহ তায়ালার চাদর। সবচেয়ে বড় এবং সর্বপ্রথম গুনাহ হলো অহংকার । অহংকারের করণে শয়তান চিরতরে আল্লাহ তায়ালার রহমত থেকে হয়েছে ।

এক হাদীস আছে, তুমি কল্যাণের চাবি হও এবং অকল্যাণের তালা হও । অর্থাৎ আমাকে মৌমাছির মত হতে হবে । মাছির মত হওয়া যাবে না। মাছি রোগের কারণ আর মৌমাছি রোগ মুক্তির কারণ । উওম আখলাকের বুনিয়াদ বা ভিত্তি হলো ৩টি আমল । (১) যে তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে তার সাথে ভালো ব্যবহার করো । (২) যে তোমাকে জুলুম করেছে তাকে মাফ করে দাও । (৩) যে তোমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে তার সাথে সম্পর্ক কায়েম কর । এই তিনটি আমল করতে পারলে আল্লাহ তায়ালা তার হিসাব সহজ করে দিবেন ।

এখলাছে নিয়তঃ- এখলাছে নিয়তের উদ্দেশ্য হলোঃ যে কোন কাজ একমাত্র আল্লাহ তায়ালাকে রাজী খুশী করার নিয়তে করা । একমাত্র আল্লাহ তায়ালাকে রাজী করার নিয়তে যেমন আমরা নামাজ আদায় করি তেমনি সংসারের অন্যান্য কাজগুলোও আল্লাহ তায়ালাকে রাজী করার নিয়তে করা ।

আল্লাহ তায়ালাকে রাজী করার নিয়তে কেউ যদি একটা খেজুরও দান করে তাকে পাহাড় পরিমান নেকি দান করা হয়। নিয়ত সহিহ না থাকার কারণে হাশরের ময়দানে আলেম, দাতা, শহীদও আযাবে গ্রেফতার হয়ে যাবে ।

হুজুর (সঃ) বলেন, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের বাহ্যিক সুরত ও সম্পদ দেখেন না । তিনি তোমাদের অন্তর ও আমল দেখেন, অন্যত্র নবিজী (সঃ) বলেন, দ্বীনের কাজে এখলাছের এহতেমাম করবে । কেননা এখলাছের সাথে সামান্য আমলও যথেষ্ট। এক হাদীসে বর্ণিত আছে, আল্লাহ তায়ালা আমলের মধ্যে ঐ আমলই কবুল করেন যাহা একমাত্র তার জন্যই করা হয় । কেয়ামতের দিন যখন আমলসমূহ আল্লাহ তায়ালার সামনে পেশ করা হবে আল্লাহ তায়ালা কোন কোন লোকের আমল সম্পর্কে বলবেন, ইহা কবুল করে নাও, আর কোন কোন লোকের আমল সম্পর্কে বলবেন, ইহা ফেলে দাও । ফেরেশতাগন বলবেন আপনার ইজ্জত ও বুজুর্গির কসম, আমরা তো এই সমস্ত আমলের মধ্যে ভালো ছাড়া কিছু দেখি নাই । আল্লাহ তায়ালা বলবেন, তারা এই সমস্ত আমল আমার জন্য করে নাই । আর আমি আজকের দিনে সেই আমলকে কবুল করবো যা শুধু আমার সন্তুষ্টির জন্য করা হয়েছে ।

মুমিনের নিয়ত আমলের চেয়েও শক্তিশালী । এক হাদীসে আছে, যে ব্যক্তি ঘুমানোর সময় তাহাজ্জুদের নিয়তে ঘুমায়,কিন্তু ঘুম ভাঙ্গে না আল্লাহ তায়ালা তাকে তাহাজ্জুদের নেকি দান করবেন ।

আরেক হাদীসে আছে, যার সারাংশ হলো, এক বুজুর্গ একটি টিলার নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন,তখন দুর্ভিক্ষের সময় ছিল, তিনি মনে মনে ভাবলেন এই বালুর টিলা যদি খাদ্যশস্যের স্তুপ হতো তবে তা বনি ঈসরাঈল গোত্রের লোকদেরকে খাওয়াতাম। আল্লাহ তায়ালা ঐ সময়ের নবীকে জানিয়ে দিলেন যে, আমি তার নিয়ত অনুযায়ী নেকি লিখে দিয়েছি ।

দাওয়াত ও তাবলীগঃ- কোরআনের ফয়সালা অনুযায়ী মুমিনের জান ও মাল আল্লাহ তায়ালা জান্নাতের বিনিময়ে খরিদ করে নিয়েছেন । এজন্য আল্লাহ তায়ালার দেওয়া জান, মাল ও সময় নিয়ে আল্লাহ তায়ালার রাস্তায় বের হয়ে জান, মাল ও সময়ের সঠিক ব্যবহার শিক্ষা করা এবং সারা দুনিয়ায় দ্বীন জিন্দা করার চেষ্টা করাই হলো এই মেহনতের মূল উদ্দেশ্য।

আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক নবীকে একটি নির্দিষ্ট এলাকা এবং নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পাঠিয়েছেন। যেমন মূসা (আঃ) কে মিশরের জন্য, শোয়াইব (আঃ) কে মাদাইন শহরের জন্য এবং নূহ (আঃ) কে তার কওমের জন্য । আর আমাদের নবীর মেহেনতের ময়দান হলো সারা দুনিয়া এবং সময় হলো কেয়ামত পর্যন্ত । আমাদের নবী যেহেতু শেষ নবী তাই মেহনতের দায়িত্ব এখন এই উম্মতের উপর ।

আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে নবী আপনি বলুন, এটাই আমার রাস্তা, আমি মানুষকে জেনে বুঝে ডাকি, এটা আমার কাজ এবং যারা আমাকে অনুসরণ করবে তাদেরও একই কাজ । এক হাদীসে আছে, তুমি যদি দ্বীনের একটি কথা জান তবে অপরকে পোঁছিয়ে দাও।দুনিয়াতে দ্বীন জিন্দা করার জন্য প্রত্যেক নবী এবং সাহাবাদেরকে চরম নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে । দাওয়াতের এই মেহনত করতে গিয়ে কোন নবীকে আগুনের মধ্যে পড়তে হয়েছে, কাউকে মাছের পেটে যেতে হয়েছে, কারও শরীর থেকে লোহার চিরনী দ্বারা চামড়া-গোশত খসিয়ে নেওয়া হয়েছে। তবুও তারা দ্বীনের মেহনতে সামান্যতম কমতি করেন নি ।

সবচেয়ে বেশী কষ্ট দেওয়া হয় আমাদের নবীকে। এ ব্যাপারে নবীজী নিজেই বলেছেন, সত্যের দাওয়াতের জন্য আমাকে যত কষ্ট দেওয়া হয়েছে অন্য কোন নবীকে এত কষ্ট দেওয়া হয়নি । নবীজী দাওয়াত দিতে গেলে মুখের উপর থুথু দিত । সেজদার সময় ঊটের নাড়িভূড়ি চাপিয়ে দিয়েছিল । চলার পথে বাবলা কাটা ছড়িয়ে রাখতো । সূরা লাহাব নাযিল হওয়ার পর নবীজীর দুই মেয়েকে আবু লাহাবের দুই ছেলে এক সাথে তালাক দেয় । ওহুদের ময়দানে দান্দান মোবারক শহীদ হয় । পর পর তিন চাঁদ বা দুই মাস নবীজীর কোন বিবির ঘরে আগুন জলে নাই। সর্বোপরি তায়েফ বাসীরা নবীজীকে যে কষ্ট দিয়েছে পৃথিবীতে তার কোন নজীর নাই ।

হযরত বেলাল (রাযিঃ) কে উত্তপ্ত বালুর উপর চিত করে শুয়াইয়া গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়া আঘাত করা হতো । হযরত খাব্বাব (রাযিঃ) কে জলন্ত কয়লার উপর শোয়াইয়া টানা হেঁচড়া করা হতো। তবুও তারা ঈমান ছাড়েন নাই ।

হযরত আবু বকর (রাযিঃ) দুনিয়াতে দ্বীন জিন্দা করার জন্য পুরা জান পুরা মাল ব্যায় করেছেন । খাদিজা (রাযিঃ) ছিলেন মক্কার মধ্যে সবচেয়ে ধনী মহিলা । দ্বীনের খাতিরে সবকিছু বিসর্জন দিয়ে তালিযুক্ত কাপড় পরিধান করে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন । হযরত সুমাইয়া (রাযিঃ) দ্বীনের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে সর্বপ্রথম শাহাদতের গৌরব অর্জন করেন । উপরের আলোচনা থেকে দেখা যায় সাহাবাদের মধ্যে পুরুষদের পাশাপাশি মহিলারাও জানমালের কোরবানী করেছেন ।

সুতরাং আখেরী নবীর উম্মত হয়ে আমরা যদি এই মেহনত না করি, কাল কিয়ামতের মাঠে আমাদেরকে জবাবদিহি করতে হবে। আর আমরা যদি এই মেহনত করি, আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতে ইজ্জত ও সম্মান দান করবেন । প্রথমত এই মেহনত শিখার জন্য আমরা আল্লাহর রাস্তায় বের হওয়ার নিয়ত করি ।

আল্লাহ তায়ালার রাস্তায় এক সকাল বা এক বিকাল ব্যায় করা দুনিয়া ও দুনিয়ার মধ্যে যা কিছু আছে তার চেয়ে উওম । যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার রাস্তায় এক টাকা খরচ করে আল্লাহ তায়ালা তাকে সাত লক্ষ টাকা দান করার নেকি দান করবেন । আল্লাহ তায়ালার রাস্তায় বের হয়ে যে ব্যক্তি কোন নেক আমল করবে আল্লাহ তায়ালা তাকে ৪৯ কোটি নেক আমলের সওয়াব দান করবেন । নবীওয়ালা এই কাম শেখার জন্য নিজের পরিবেশ থেকে আলাদা না হলে বুঝে আসবে না । আমরা সবাই জানি, মাটির চুলাতে সারা জীবনই আগুন জ্বালিয়ে রান্না করা হয় । তাই বলে চুলার মাটি কখনো ইট হয় না । আবার কিছু মাটিকে বিশেষ মেহনতের মাধ্যমে অল্প দিনেই ইটে পরিণত করা হয়। চুলার মাটি মূল মাটির সাথে লেগে থাকার কারনে ইটে পরিণত হয় না । আর ইট ভাটার মাটি মূল মাটি থেকে আলাদা হওয়ার কারনে ইটে পরিণত হয়।

আয় আল্লাহ ! আমাদেরকে বুঝার এবং আমল করার তৌফিক দান করুন। আমিন।

তাশকিলঃ-
Next Post Previous Post