মাশওয়ারার গুরুত্ব ও আদবের বয়ান

মাশওয়ারার গুরুত্ব ও আদবের বয়ান

দাওয়াত ও তাবলীগের মধ্যে মাশওয়ারার গুরুত্ব অনেক বেশি। আল্লাহতায়ালা এ সম্পর্কে কুরআন শরীফে বর্ণনা করেছেন, মাশওয়ারা করে চলনেওয়ালা আল্লাহ্ পাকের সবচেয়ে বেশি নৈকট্য হাছিল করেন। আর যাহারা মাশওয়ারা মত চলে না তাহারা শয়তানের জালে পরে যায়। মাশওয়ারার আদব বড় সূক্ষ্ম। এজন্য তাহারাই ঐসব আদবসমূহ পুরা করতে সক্ষম হবে যাহাদের মধ্যে দাওয়াতের সিফত পয়দা হয়েছে।

ছিফতগুলো নিম্নরূপঃ

  • মাশওয়ারা করনেওয়ালা আল্লাহতায়ালার দিকে মোতাওয়াজ্জাহ হয়ে বসবেন যেন আল্লাহপাক আমাদের মাশওয়ারাকে শুনছেন।যদি আমরা দুই জনে মাশওয়ারা করি তাহলে তৃতীয় হলেন আল্লাহতায়ালা। ইহাই আল্লাহতায়ালা কুরআন শরীফে বর্ণনা করেছেন।

(অর্থাৎ আপনি কি ভেবে দেখেননি যে, নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে যা কিছু আছে, আল্লাহতায়ালা তা জানেন। তিন ব্যক্তির এমন কোন পরামর্শ হয় না যাতে তিনি চতুর্থ না থাকেন এবং পাঁচজনের হয় না যাতে তিনি ষষ্ঠ না থাকেন। এতদপেক্ষা কম হোক বা বেশি হোক, তারা যেখানেই থাকুক না কেন তিনি তাদের সাথে আছেন। তারা যা করে, তিনি কেয়ামতের দিন তাদেরকে তা জানিয়ে দিবেন। নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা সব বিষয়ে সম্যক জ্ঞাত।)
  • আমাদের মাশোয়ারা করনেওয়ালাদের দীলে আপোষে মহব্বত হবে, যেহেতু হাদীসে কুদসীতে আছে, “আপোষে মহব্বতকারীদের জন্য আমার মহব্বত ওয়াজিব করে দিলাম।”
  • আপোষে এমন মন কষাকষি না হয় যে উভয়ের দিলের মধ্যে এখতেলাফ হয়ে যয় এবং দিলের দিক দিয়ে এক অপরকে ঘৃণা করে।
  • কেউ কারও উপর অসন্তুষ্ট বা রাগ হবে না। নতুবা আল্লাহতায়ালার রহমত হতে বঞ্চিত হয়ে যাবে এবং ঈমান দুর্বল হয়ে পড়বে। হযরত মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) বলতেন, “কাম করনেওয়ালাদের উপর আমার দু’টি ভয়, নিজের মধ্যে ছয় নম্বরের গুণকে পয়দা না করা এবং শুধুমাত্র জামাত বের করতে থাকা। ফলে নিজেও ছওয়াব থেকে বঞ্চিত হতে থাকবে এবং ঈমানও দুর্বল হতে থাকবে। নিজের মধ্যে ছয় নম্বরের হাকিকত পয়দা করা জরুরী। অর্থাৎ যাতে কালেমায় তাওহীদের মেহনতের দ্বারা নিজের ঈমান বাড়তে থাকে। নিজের নামাযের মধ্যে খুশু ও খুজু পয়দা হতে থাকে।  এক অপরের প্রতি একরাম এবং হক্ব আদায় করার ফিকির বাড়তে থাকে এবং বে-একরামী থেকে বাঁচার চেষ্টা করতে থাকে। নিজের কারনে ন্য কাহারও দিলে কষ্ট না হয়। এবং আমাদের মাশওয়ারা আল্লাহতায়ালার দরবারে কবুল হচ্ছে কিনা এ সম্পর্কে সর্বদা ভীত থাকা।”

মাশওয়ারার তরীকা ও করার নিয়মঃ

  • কেহ নিজের রায়কে একীনের সাথে সহী না ভাবে। নতুবা এটাই প্রমানিত হবে যে, আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে আমার উপর সহি রায়ের ফয়জান হচ্ছে। কেননা এই মাকাম সবার জন্য না।
  • কেউ নিজের রায়ের উপর এছরার করবেনা এটার দ্বারা অহংকার প্রকাশ পাবে এবং নফস বিজয়ী হবে। শয়তান তাহলে মাশওয়ারা করনেওয়ালাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটাবে ও আপোষে শত্রুতার সৃষ্টি করাবে।
  • কোন মাশওয়ারা দেনেওয়ালা অন্যের রায়কে প্রত্যাখান করবেনা এতে ঐ ব্যক্তি অপমানিত হয় বরং অন্যের রায়কে এই মনে করবে যে, হতে পারে এর মধ্যে খায়ের আছে। হার একরাম বজায় রেখে নিজের রায় পেশ করবেন। এটাই হল আল্লাহতায়ালাকে রাজি করার উপায়।
  • মুখে মিষ্টি ও দীলকে নরম রাখবে। আল্লাহতায়ালা যেরূপ হুযুর (সা) এর ছিফাত বয়ান করেছেন এবং একটি জিনিসের প্রতি সতর্ক করেচেন যাহা আমাদের জন্য বড় শিক্ষামূলক। আল্লাহতায়ালা হুযুর (সা) কে নরম বানিয়েছেন, যদি তিনি কটুকথা ও শক্ত দীলওয়ালা হতেন, তবে তিনি নবী হওয়া সত্ত্বেও এবং সমস্ত ছিফাতের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও মানুষ হুযুর (সা) এর সাথে জুড়তেন না। বরং আলাদা হয়ে যেত্ োএটা আখলাকের উচ্চ দরজার ছিফত। যাহার মধ্যে উক্ত ছফত এসে যাবে সেই ব্যক্তি আল্লাহতায়ালার প্রিয় বান্দা হয়ে যাবেন। উম্মত তার সাথে জুড়তে থাকবে এবং তার মধ্যে খেলাফতের ছিফত হাছিল হবে। অর্থাৎ মানুষের দীলর মধ্যে তার খেলাফত হবে। সুতরাং মাশওয়ারা সূক্ষ আমল। এর দ্বারাই দুনিয়াতে দাওয়াত ছড়াবে এবং দায়ীর দরজা কায়েম হবে। দুনিয়াতে দাওয়াত উম্মতের মধ্যে কায়েম না হওয়ার কারনে শয়তান উম্মতের মধ্যে বিভিন্ন দল ও ক্বওমী জজবা পয়দা করে দিয়েছে। আদল ও ইনসাফকে শেষ করে দিয়েছে। বাতেলকে জয় করে দিয়েছে। হক্বওয়ালাদের বাতেলদের অনুগত করে দিয়েছে। এইজন্য দাওয়াতকে সর্বপ্রথম জিন্দা করতে হবে। এবং প্রত্যেক মুসলমানকে তার জিন্দেগীর উদ্দেশ্য অর্থাৎ দাওয়াতের উপর আনতে হবে এবং প্রত্যেককেই দায়ী বানাতে হবে, যেন তার গোটা জীবন কুরআন ও হাদীসের বাতানো তরীকার উপর এসে যায়। তবে আল্লাহতায়ালার তরফ থেকে রহমত, বরকত, দীলের শান্তি এবং মদদ ও সাহায্যের দরজাসমূহ খুলে যাবে এবং আল্লাহতায়ালার গায়েবী নিযাম পক্ষে হয়ে যাবে। এই ব্যক্তি উভয় জাহানে কামিয়াব হবে।
আল্লাহতায়ালা কুরআন শরীফে স্বীয় নবী (স) এর শানে একটি আয়াত নাযিল করেন, “আপনি সাহাবায়ে কেরামদের সাথে পরামর্শ করুন।”
পরে অন্য আয়াত নাযিল করেন, “যারা তাদের পালনকর্তার আদেশ মান্য করে এবং নামাজ কায়েম করে, পারস্পরিক পরামর্শক্রমে কাজ করে এবং আমি তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে ব্যায় করে।”
কিয়ামত পর্যন্ত আনেওয়ালা উম্মত মাশওয়ারার সাথে চলবে তবে সঠিক পথে থাকবে। এজন্য বদরে খাব্বাব বিন মুনজার (রা) এর রায়কে জিবরাইল (আ) এর দ্বারা সহী প্রমান করেছেন। বদরের কয়েদীদের ব্যাপারে হযরত ওমর (রা) এর রায় মোতাবেক আয়াত নাযিল করেছেন এবং হুযুর (স) উহুদের যুদ্ধে নৌজোয়ানদের রায়কে কবুল করে নিয়েছেন এবং আল্লাহতায়ালা উহাকে ভূল বাতান নাই। এটা আমাদের জন্য উসুল কায়েম করেছেন। যখনই এই উসুল আমাদের মধ্যে জিন্দা হয়ে যাবে, তখন উম্মতে মুসলিমার মধ্যে ঈমান ও ইসলামের জজবা পুরোপুরি এসে যাবে এবং তারা বাতেলদের উপর জয় হবে। হযরত মাওলানা ইউসুফ সাহেবও (রহ) এরকম ফরমায়েছেন। হয়তো আহলে বাতেলকে হক্বের দিকে ফিরাবেন এবং যারা হক্বের দিকে ফিরবেনা তাদেরকে আপেেেষ টকরাও পয়দা করে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দিবেন। অথবা মুসলমানদের দ্বারা হারিয়ে দিবেন। অথবা আপোষের মধ্যে লাগিয়ে দিবেন। সম্ভবত এই আয়াতটি ইঙ্গিত এই দিকেই, "বরং আমি সত্যকে মিথ্যার উপর নিক্ষেপ করি, অতঃপর সত্য মিথ্যার মস্তক চুর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়, অতঃপর মিথ্যা তৎক্ষণাৎ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তোমরা যা বলছ, তার জন্যে তোমাদের দুর্ভোগ।"
প্রথমে দাওয়াতওয়ালার মোজাহেদার মধ্যে যাবে এবং আল্লাহতায়ালা পরীক্ষা নিবেন যা এই আয়াতে ফরমান- " এবং অবশ্যই আমি তোমাদাদের পরীক্ষা করবো। কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও ছবরকারীদের।"

এবং সর্বশেষ ফরমানঃ

তোমাদের মধ্যে যে মক্কা বিজয়ের পূর্বে ব্যয় করেছে ও লড়াই করেছে, সে সমান নয়। এরূপ লোকদের মর্যাদা বড় তাদের অপেক্ষা যারা পরে ব্যয় করেছে ও লড়াই করেছে। তবে আল্লাহ উভয়কে কল্যাণের ওয়াদা দিয়েছেন।
মোজাহেদার পর খোশখবরীর ওয়াদা যে, যত জান ও মালের এবং নিজের দুনিয়াবী তাকাজার কুরবানী এমনভাবে দিতে থাকবে যে, নিজের জান ও মাল আল্লাহর রাস্তায় বেশি বেশি লাগীবং নিজের দুনিয়াবী তাকাজা ভংগ হয় এবং দীল ও দেমাগ আল্লাহতায়ালার দীনের মধ্যে লাগে। তবে ছাবেকীনদের মধ্যে হবে এবং তাদের সাথে চলনেওয়ালা আসহাবুল ইয়ামীনদের মধ্যে হবে। আর এরা উভয়ই হবে কামিয়াব। তারপর আল্লাহতায়ালা একটি আয়াতে মোজাহিদীনদের দুইটি দরজা কায়েম করেছেন।
কখনো মক্কা বিজয়ের পরের ঈমানওয়ালাদের দরজা আগের ঈমানওয়ালাদের বরাবর হতে পারে না।
 কারণ মক্কা বিজয়ের পর গনীমতের মাল ব্যাপক আসা শুরু হলো এবং জয়ের আসা কায়েম হয়ে গেলো।

(১৯৯৫ ইং সনে হযরত মাওঃ সাইদ আহমদ খান রহঃ হযরতজী রহঃ এর আখেরি হজ্জের সফরে ঊক্ত এরশাদাত মদীনা মোনায়ারায় হজরতজী রহঃ এর কাছে লিখেন। হজরতজী রহঃ পরার পর উনার সফর সংগী সাথীদের পড়ে শুনানো হয়।)
Next Post Previous Post